বাংলা নববর্ষ ও বাঙ্গালীর ইতিহাস
- Posted by Abu Zar Giffary Shaon
- Categories বাংলা ভাষার ইতিহাস
- Date April 14, 2022
- Comments 1 comment

বছর ঘুরে আবারো চলে এলো একটি বাংলা নতুন বছর। ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।যদিও সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আমরা আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করি তারপরেও পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি প্রধানতম জাতির একটি নিজস্ব বর্ষপঞ্জি রয়েছে এবং বছরের প্রথম দিনটকে স্মরণীয় রাখতে তারা উৎসব পালন করে থাকে। যেমন চাইনিজদের ‘চুন জি’, তিব্বতিদের ‘লোসার’, জাপানিজদের ‘শোগাতসু’, কোরীয়দের ‘সিওল্লাল’, ভিয়েতনামিজদের ‘তেত’ , ইরানিয়ানদের নওরোজ ও আরবদের হিজরী ইত্যাদি উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি । এই প্রত্যেকটি উৎসবের পিছনে নিজস্ব জাতিসত্ত্বা গড়ে উঠার যেমন একটি ইতিহাস রয়েছে ঠিক তেমনি এই উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে একটি জাতির সংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা ও লালিত মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে।
বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস হাজার বছরেরও পুরোনো শুধু তাই নয় প্রাচীন পৃথিবীর সমৃদ্ধ জনপদগুলোর মধ্যে বাংলা অন্যতম।১৯০৭ সালে তিব্বতের রাজগ্রন্থশালা থেকে হরপ্রসাদশাশ্ত্রী কতৃক উদ্ধারকৃত ‘চর্যাপদ’কে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আদি নিদর্শন।প্রথিতযশা ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০ খ্রীষ্টাব্দের সমসাময়িক পর্যায়ে।ঐ সময়টায় বাংলায় পাল শাসন চলতেসিলো। পাল সাম্রাজ্য ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদী পরবর্তী যুগের একটি সাম্রাজ্য যার উৎসস্থল মূলত ছিলো বাংলা। খ্রীষ্টীয় নবম শতাব্দীর দিকে পাল’রা ভারতের উত্তরাঞ্চলের প্রধানতম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। বৌদ্ধধর্মের অনুসারী পাল সম্রাটরা ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য,স্থাপত্য ও চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। নওগাঁয় অবস্থিত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে বা নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মাণ করেন পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল।১৭৯৮ খ্রীষ্টাব্দে স্যার আলেকজেন্ডার কানিঙ্গহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন। ইউনেস্কোর মতে , সোমপুর বিহার দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার। আয়তনে এরসাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা করা যেতে পারে।শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয় বরং চীন ,তিব্বত,মালয়েশিয়া, ইদোনেশিয়া মায়ানমার(তৎকালীন ব্রহ্মদেশ) প্রভৃতি অঞ্চল থেকেও বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। দশম শতকে এই বিহারের আচার্য ছিলেন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর। পালদের সাথে আরব আব্বাসীয় খিলাফতের সুসম্পর্ক বজায় ছিলো বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় এবং বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ এই যুগেই ভারতীয় সভ্যতার গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কীর্তিগুলোর সাথে পরিচিতি লাভ করে একইসাথে বাংলায় প্রথম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে ।একাদশ শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে যারফলে সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস পায় । বরেন্দ্রতে কৈবর্ত বিদ্রোহ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে হিন্দু সেনবংশের পুনুরুথান এর ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
১২০৪ সালে তুর্কি সেনাপতি মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর অভিযানের মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রাচীন যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে ও মধ্যযুগের সূচনা হয়।প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শওকত আলী রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এ বাংলায় তুর্কি আক্রমণের প্রেক্ষাপট ও সমসাময়িক বাংলার সমাজবাস্তবতা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
মধ্যযুগের বাংলা মূলত বাংগালাহ সালতানাত বা সুবেহ বাংলা নামে অধিক পরিচিত ছিলো। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির সুলতানগণ বারবার আক্রমণ চালিয়েও বাংলাকে নিজেদের অধিকারে নিতে ব্যর্থ হন।এই সময় বাংলার সুলতানগণ স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন।১৫৩৮ সালে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাংলার রাজধানী গৌড় অধিকার করেন আর এর মধ্যদিয়ে বাংলায় দুইশত বছরের স্বাধীন সুলতানী যুগের অবসান ঘটে। কিন্তু বাংলায় হুমায়ুনের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরের বছর ১৫৩৯ সালে চৌসারের যুদ্ধে হুমায়ুনের পরাজয়ের পর বিজয়ী আফগান নেতা শের খান গৌড় আক্রমণ করেন এবং মুঘল সুবেদার জাহাঙ্গীর কুলিকে পরাজিত করে গৌড় দখল করেন। ১৫৭৬ সালের জুলাই মাসে মুঘল ও আফগানদের মধ্যে সংঘটিত রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ কররানীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় আফগান শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং সূচিত হয় মুঘল শাসন।
আবহমান বাংলা কৃষিনির্ভর । পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত দক্ষিণ হিমালয়ের পলিপ্রবণ এই অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষিই মূলত হাজার হাজার বছর ধরে। আর তাই স্বভাবতই, বাংলার বর্ষপঞ্জি কিংবা ঋতুধর্মী উৎসবও সেই কৃষিকেন্দ্রিক কারণ কৃষিকাজ ছিলো বিশেষ ঋতুনির্ভর । ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যত্ন বা পরিচর্যা ,ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন-তারিখ পঞ্জিকা অনুযায়ী নিষ্পন্ন করা হতো । শুধু ফসল আর উৎসব নয় বাঙ্গালি কৃষকের পারিবারিক ও সামাজিক কাজকর্ম , বিবাহ ও জীবনের সব বিষয়েই বাংলা সাল ছিলো এক ও অনন্য। সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই যদিও সেখানে সালের কোনো হিসাব ছিলো না। শুধু বাংলা নয় আসাম, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলেও বছরের প্রথম দিন উদযাপনের রীতি ছিলো। বাংলা মাসের নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে তবে বহুল প্রচলিত মতবাদ হচ্ছে, নক্ষত্রমন্ডলে চাঁদের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম থেকে এই মাসগুলোর নামকরণ হয়েছে যেমন বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ , জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ , শ্রবন থেকে শ্রাবন , আশ্বীনি থেকে আশ্বিন , কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, চিত্রা থেকে চৈত্র প্রভৃতি।
বাংলায় মুঘল শাসন স্থায়ী হওয়ার পর জমি ও কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতে গিয়ে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কারণ মুঘলদের রাজ্যপরিচালনা ও রাষ্ট্রীয় কার্যবিধি আরবি হিজরি সন অনুসারে পালিত হতো। হিজরি সন চন্দ্রভিত্তিক আর চন্দ্র ও সৌরবর্ষের গণনা রীতিতে পার্থক্য রয়েছে। পৃথিবীর নিজ কক্ষপথে ঘুরতে সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। আবার চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধিতে সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন ১২ ঘন্টা। যে কারণে এক চান্দ্র বছর হতে সময় লাগে প্রায় ৩৫৪ দিন ৮ ঘন্টা ৪৮ মিনিট। এক্ষেত্রে চন্দ্র মাসভিত্তিক বছরে ১০ থেকে ১১ দিনের তারতম্যে ঋতুচক্রের সাথে সামঞ্জস্য থাকে না। আর কৃষিকাজ যেহেতু চাঁদের হিসেবের সাথে মিলে না তাই কৃষকদের অসময়ে খাজনা পরিশোধ করতে হতো যেহেতু কৃষকরা ফসল বিক্রি করেই খাজনা দেন। এই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে মুঘল সম্রাট জালাল-উদ-দীন মুহাম্মদ আকবর বাংলা সৌর বর্ষপঞ্জি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এর দায়িত্ব প্রদান করেন ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীকে। সম্রাটের নির্দেশে আরবি হিজরী সন ও ইরানে প্রচলিত ফার্সি সৌরসনের উপর ভিত্তি করে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দে নতুন বাংলা সন ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ বিনির্মাণ করেন ফতেউল্লাহ শিরাজী।১৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর হয় আকবরের সিংহাসন আরোহনের সময়(৫ই নভেম্বর ১৫৫৬) থেকে। এজন্য ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরি সালের মুহররম মাস ছিলো বাংলা বৈশাখ মাস , তাই বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
তাই আকবরের সময়কাল থেকেই বাংলায় পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয় এবং তখন থেকেই বাংলা চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে সকল জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূ-স্বামীদের খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়।এবং তার পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা হচ্ছে একটি নতুন হিসাব বই যা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।
এভাবেই একটি আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে অতীতের সব দায়দেনা মিটিয়ে নতুন বছরের যাত্রা শুরু করে বাংলার মানুষ আর তা হয়ে যায় আবহমান বাংলার ইতিহাসেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
1 Comment
অত্যন্ত তথ্যবহুল একটি লেখা!!