মে দিবসের ঘটনাপ্রবাহ

আজকের দিনের যেকোনো স্কুল পড়ুয়া একটি বাচ্চাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ১লা মে কি দিবস? বাচ্চাটি হয়তো সানন্দে উত্তর দিবে, মে দিবস তথা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। “দুনিয়ার মজদুর এক হও” স্লোগানে যে মে দিবস আজ কম্পিত হয়ে ওঠে, সে মে দিবস সম্পর্কে আমরা ঠিক কতটুকু জানি? কিছু মিছিল বা মাথায় লাল কাপড় বেঁধে উচ্চস্বরে বক্তৃতা দেওয়ার ভেতর মে দিবস সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর পিছনে আছে এক করুণ ইতিহাস। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের দুইটা বিষয়ে আলোকপাত করতে হবেঃ
১) মে দিবস কি এবং কেনো?
২) মে দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
চলুন জেনে নেওয়া যাক!
১) মে দিবস কি এবং কেনো?
সময়টা তখন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ। শ্রমজীবী সংগঠন কমিন্টার্নের দ্বিতীয় সভায় স্লোগান ছিলো,”সকল দেশের শ্রমিক ও নিপীড়িত জনগণ এক হও!” লেলিনের নেতৃত্বে হওয়া সে সভায় শ্রমিকদের কেনো নিপীড়িত বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো? এ ব্যাখ্যা খুঁজতে আমাদের আরো পিছনে আলোকপাত করতে হবে। ১৮৬৩ সালের পহেলা জানুয়ারি, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেদিন দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে যে কালো অধ্যায় থেকে আমেরিকাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, সেখানে তিনি সফল হলেও সে অধ্যায়ের শিকড় আমেরিকা থেকে পুরোপুরি উত্খাত করতে পারেননি। কেননা দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও যে শ্রমিকদের উপর তখনকার আমেরিকার পুঁজিবাদ দাঁড়িয়ে ছিলো, সেই শ্রমিকদেরই তারা নব্য দাসরুপে ব্যবহার করা শুরু করেছিলো। দৈনিক ১৪-১৮ ঘণ্টা কাজ করার পরও সেসব শ্রমিকের না ছিলো একটা সমৃদ্ধ জীবন, না ছিলো জীবনের নিরাপত্তা। এরই ফলশ্রুতিতে কর্মঘন্টা ও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে আমেরিকার শিকাগো শহর। ১৮৮৬ সালের ১লা মে, শিকাগোর শ্রমিকরা সেদিন বাঁচার মতো বাঁচার যে আকাঙ্ক্ষায় স্বপ্ন নিয়ে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিলো, সেখানেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পুঁজিবাদের আমলারা এবং তাদের পুলিশ বাহিনী। শ্রমিকদের উপর পুলিশের হামলায় সেদিন মারা যায় প্রায় ১০-১২ জন নিরীহ শ্রমিক। সেদিন থেকেই মে দিবসের সূত্রপাত।
২) মে দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি!
শ্রমিকদের স্মরণে যে মে দিবস আমরা আজ পালন করি সেটা সারাবিশ্বেই পালিত হয়। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির শুরুটা কোথায়? কীভাবে শিকাগোর শ্রমিকদের আন্দোলন পুরো বিশ্বের মজদুরদের এক করে ফেললো?
সাল ১৮৮৯ ইং। ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ রেমন্ড লাভিনে ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরে ঘটে যাওয়া বর্বর হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব দেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর মধ্যে ঝামেলাও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ১৮৯৪ সালে মে দিবসে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। তবুও বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের একটা শুভক্ষণ হয়ে ওঠে ১লা মে।
শিকাগোর শ্রমিকেরা যে আটঘণ্টা কাজের সময় নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলো, সেটা পূর্ণতা পায় সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১৯০৪ সালে৷ যে দাবী আজ প্রতিটা শ্রমিকের অধিকার বলে বিবেচিত হয়।
এশিয়ার থেকে শুরু করে ইউরোপের পুঁজিবাজার অতিক্রম করে সূদূর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশেও আজ মে দিবস শ্রমিকদের এক করে। বাংলাদেশ, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা সহ প্রায় ৮০টা দেশে এ দিনটা সরকারী ছুটির দিন।
এসব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অনেক উর্ধ্বে গিয়ে মে দিবস আজ শ্রমিকদের আন্দোলিত করে, অনুপ্রেরণা যোগায় স্বাধীনভাবে বাঁচতে, তাদের ন্যায্য দাবী নিয়ে রাজপথে লড়তে। পুঁজিবাদ যেখানে আড়ষ্ট হয়, শ্রমিকের কণ্ঠে সেখানে বিজয়ের মাজেজা মিলে, “দুনিয়ার মজদুর এক হও” স্লোগানে।